মালিকুজ্জামান কাকা, যশোর : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চারটি জোনে তুলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। এক সময়ের অনাবাদি ও পতিত জমিতে তুলার চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন এই অঞ্চলের তুলা চাষিরা। অনেক প্রান্তিক ও বর্গাচাষি অর্থকরী এ ফসল চাষে দিন দিন আরো বেশি হারে ঝুঁকে পড়ছেন বলে যশোর আঞ্চলিক তুলা উন্নয়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে। লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তুলা চাষ। কয়েক বছর আগে এখানে রমরমা তুলার চাষ হলেও নানা কারনে চাষী এই ফসলটির চাষাবাদ বন্ধ করে দেয়।
যশোর আঞ্চলিক তুলা উন্নয়ন অফিস সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও যশোরের বিভিন্ন এলাকায় প্রতি
বছর সবচেয়ে বেশি জমিতে তুলার চাষ হয়ে থাকে। এই আঞ্চলিক অফিসের অধীনে চারটি জোনের আওতায় বর্তমানে মোট ৬৭টি তুলা
ইউনিট চালু আছে। চলতি মৌসুমে (২০২১-২০২২) এ অঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা জোনের বিভিন্ন জেলায় মোট ১৬,৬৩১ হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ হয়েছে। আবাদকৃত জমিতে ৪৫,৭৩৫মেট্রিক টন তুলা উৎপাদিত হবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। এর মধ্যে যশোর জোনে ৩,৩৫২হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ হয়েছে। প্রতিবছর জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তুলার চাষ শুরু হয় এবং চলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। জানুয়ারি মাস থেকে তুলা কর্তন শুরু হয়ে চলে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।
যশোর আঞ্চলিক তুলা উন্নয়ন অফিসের উপ-পরিচালক কামরুল হাসান জানান, তুলা চাষে কৃষকদের আগ্রহ সৃষ্টিতে জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে বা হচ্ছে। তুলা উন্নয়ন অফিস প্রতি মৌসুমে চাষিদের উদ্বুদ্ধকরণ, পরামর্শ, মাঠ দিবস, উঠান বৈঠক, নতুন নতুন জাতের বীজ সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এসব কারণে এক সময় যেসব চাষিরা তুলা চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তারা নতুন করে আবার তুলা চাষ শুরু করেছেন। এর কারন অন্য যে কোন ফসলের চেয়ে তুলা চাষ বেশি লাভজনক। তুলা বীজ থেকে উৎপাদিত ভৈজ্য তেল অধিক পুষ্টিগুন সম্পন্ন বং কোলষ্টেরল তুলনামূলক কম। তুলার চাষ বাড়লে বাজারে এ তেলের সরবরাহ বাড়বে। এছাড়া তুলা বীজের খৈল অধিক প্রোটিন সম্মৃদ্ধ। গরু মোটাতাজাকরণ, পোল্ট্রি এবং মাছ চাষের উত্তম খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। চলতি মৌসুমে হাইব্রিড হোয়াইট গোল্ড-১, রুপালি-১, সিবি হাইব্রিড-১, ডিএম-৪ এবং দেশীয় উচ্চ ফলনশীল সিবি-১৪ ও সিবি-১৫ জাতের তুলার ফলন সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এসব জাতের তুলা প্রতি বিঘায় ১৩ থেকে ১৪ মণ করে উৎপাদন হয়েছে।
এ বছর তুলা প্রতি মণ মানভেদে ৩৪০০ টাকা থেকে ৩৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চরাঞ্চলসহ অনাবাদি জমিতে তুলা চাষ করা গেলে শুধু
কৃষকরাই লাভবান হবেন না, তুলা আমদানিতে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থেরও সাশ্রয় হবে। সারা বিশ্বে তুলা অতি গুরুত্বপূর্ণ আঁশ জাতীয়
ফসল। এদেশে তুলা উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও এখন পর্যন্ত তুলা উৎপাদনের পরিমান তেমন নয়। তুলা উন্নয়ন বোর্ডের সক্রিয়তায়
বর্তমানে তুলা উৎপাদনের জমির পরিমান বৃদ্ধি পাচ্ছে। তুলা চাষের উপযোগী জমিঃ তুলা চাষের জন্য উৎকৃষ্ট মাটি দোআঁশ ও বেলে
দোআঁশ। পর্যাপ্ত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ যেকোন মাটিতে তুলা হয়। খুব বেশি বেলে বা কর্দমকণা সমৃদ্ধ মাটি তুলা চাষের জন্য উপযুক্ত নয়। যে
জমিতে বৃষ্টির পানি দাঁড়ায় না বা স্বাভাবিক বন্যার পানি উঠে না এরূপ জমি তুলা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
যে জমি স্যাঁতসেঁতে, ছায়াযুক্ত এবং যেখানে বৃষ্টির পানি ২-৬ ঘন্টার মধ্যে নেমে যায় না সেরূপ জমি তুলা চাষের জন্য নয়। মাটির পিএইচ মান ৬.০-৭.৫ হওয়া উত্তম। মাটি বেশি অম্লীয় হলে জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরি: আমাদের দেশে বর্তমানে উন্নত পদ্ধতিতে তুলা চাষ হচ্ছে এবং এই সময় বর্ষাকাল। বর্ষার অবস্থা বুঝে মাটিতে ‘জো’ থাকা অবস্থায় ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমতল করে জমি তৈরি করতে হয়। দেশের যে অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমান কম, সেই অঞ্চলে শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে জমি চাষ করে বীজ বপন করা হয়। সমতল অঞ্চলে ভাদ্র মাসে জমি তৈরি করে বীজ বপনের উপযুক্ত করা হয়। বীজ বপনের সময়: উত্তরবঙ্গ ও পাহাড়িয়া এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় শ্রাবণের মাঝামাঝি হতে ভাদ্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মধ্য শ্রাবণের দিকে বীজ বপন উত্তম। বীজ বুনতে দেরি হলে তা অবশ্যই ভাদ্রের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে।
বীজ প্রক্রিয়াজাতকরন: বপন সুবিধার জন্য তুলাবীজ ৩-৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে তা ঝুরঝুরে মাটি বা শুকনো গোবর অথবা ছাই দিয়ে
এমনভাবে ঘষে নিতে হবে যেন আঁশ (ফাঁজ) বীজের গায়ে লেগে না থাকে এবং বীজ একটা হতে অন্যটা আলাদা হয়ে যায়। এছাড়া লঘু
সালফিউরিক এসিড দিয়ে বীজ আঁশ মুক্ত করেও বপন করা যায়। এতে বীজের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবানু ও পোকার ডিম নষ্ট হয়ে যায়।
বীজের হার: তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ওপি জাতের ক্ষেত্রে প্রতি একরে প্রায় ৩ কেজি এবং হাইব্রিড বীজের ক্ষেত্রে প্রতি একরে ১.৫-১.৮ কেজি বীজ দরকার হয়। বপন পদ্ধতি: উত্তর-দক্ষিন লাইন করে সারিতে বীজ বপন করা উত্তম। হাত লাঙল দিয়ে হালকাভাবে সারি টেনে অনুমোদিত সার প্রতি সারিতে ভাল করে নিয়ে তা প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর নির্ধারিত দূরত্ব ১.২৫ সেঃ মিঃ থেকে ২.৫ সেঃ মিঃ গভীরে ৩/৪টি বীজ বুনে তা ঢেকে দিতে হবে। সিবি ১ সারির দূরত্ব ১০০ সেঃ মিঃ ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৫০-৬০ সেঃ মিঃ। অন্য জাত সারির দূরত্ব ৯০-১০০ সেঃ মিঃ ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫-৫০ সেঃ মিঃ। তুলায় পোকামাকড়ের মধ্যে জ্যাসিড, জাব পোকা ও তুলার পাতা মোড়ানো পোকার উপদ্রব দেখা যায়। এসব পোকার আক্রমন সহজ নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে অনুমোদিত ঔষধ মাত্রানুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে। তুলা গাছে পাতা ঝলসানো, এনথ্রাকনোজ, নেতিয়ে পড়া, চারা ধসা ইত্যাদি রোগ হয়। বীজবাহিত রোগের জন্য বীজ শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। রোগাক্রান্ত চারা তুলে পুড়িয়ে ফেলা উত্তম। জমিতে পানিবদ্ধতা থাকবে না। রোগাক্রমণের সম্ভাবনার ক্ষেতে ৫% কপার অক্সিক্লোরাইড বা ২.৫% ডাইথেন-এমএ ৪৫ প্রয়োগ করা যাবে।
তুলা সংগ্রহ: তুলা গাছের বোল ভালভাবে ফেটে বের হলে পরিষ্কার শুকনা দিনে বীজতুলা উঠাতে হয়। সাধারণত ৩ বারে ক্ষেতের তুলা ওঠে। প্রথমবার মোট ফলনের ৪০%-৫০% তুলা উঠানো যায়। দ্বিতীয় কিস্তি ও তৃতীয় কিস্তিতে যথাক্রমে ২৫% বা ৩০% এবং অবশিষ্ট তুলা উঠাতে হয়। সাধারণত প্রথমবারের তুলা ভাল হয়। তাই এই তুলা আলাদা রাখতে হয়। তুলা উঠানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে ময়লা, মরা পাতা ও পোকায় আক্রান্ত খারাপ অপুষ্ট তুলা যেন ভাল তুলার সাথে মিশে না যায়। ভাল তুলা পৃথক করে তা ৩/৪ দিন ভাল করে শুকিয়ে গুদামজাত করতে হবে।
ফলন: স্বভাবিক অবস্থায় কৃষকের সক্রিয়তা থাকলে হেক্টর প্রতি ১২-১৫ কুইন্টাল বীজ তুলা উৎপন্ন হয়। তবে যথাযথ উন্নত প্রযুক্তি অবলম্বনে তুলা চাষ করলে ফলন এর দ্বিগুন পাওয়া যায় বলে জানা গেছে।